গলায় ক্যান্সার, হাসপাতালে দেখতে গিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ
বাংলা ভাষায় অন্তত পাঁচজন কবি কবিতার পাশাপাশি সঙ্গীতের ক্ষেত্রেও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছেন, তাঁদের একসঙ্গে বলা হয় ‘পঞ্চকবি’। তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন রজনীকান্ত সেন। অন্যরা হলেন— রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, অতুল প্রসাদ সেন। বাংলা সাহিত্যে ও সঙ্গীত জগতে নিজস্বতার জোরেই মাইলস্টোন হয়ে আছেন রজনীকান্ত সেন— কান্তকবি।
রজনীকান্ত সেনের জন্ম ১২৭২ বঙ্গাব্দের ১২ই শ্রাবণ। তিনি ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সমসাময়িক। রজনীকান্ত সেনের ডায়েরি থেকে জানা যায়, ছাত্র হিসেবে অত্যন্ত মেধাবী ছিলেন তিনি। তাঁর কথায়,
আমি কখনও বইপ্রেমী ছিলাম না। তবুও অত্যন্ত কৃতিত্বপূর্ণ ফলের জন্যে ঈশ্বরের কাছে আমি কৃতজ্ঞতা জানাই।
রজনীকান্তের মা-বাবা দু’জনই ছিলেন সঙ্গীতে যথেষ্ট দক্ষ। মা-বাবার কাছ থেকে অনুপ্রাণিত হয়েই হয়তো তিনি গানের প্রতি অনুরাগী হয়ে ওঠেন। মাত্র ১৫ বছর বয়সে ‘কালীসঙ্গীত’ রচনা করে সংগীত প্রতিভার পরিচয় দেন।
কলেজের যেকোনও অনুষ্ঠানেই ডাক পড়ত রজনীকান্ত সেনের। তিনি অল্প সময়েই গান রচনা করতে পারতেন ও সাফল্য অর্জন করেন। তাঁর লেখা একটি বিখ্যাত দেশাত্মবোধক গান:
তব, চরণ নিম্নে, উৎসবময়ী শ্যাম-ধরনী সরসা,
ঊর্ধ্বে চাহ অগণিত-মনি-রঞ্জিত নভো-নীলাঞ্চলা
সৌম্য-মধুর-দিব্যাঙ্গনা শান্ত-কুশল-দরশা।
১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সময় রবীন্দ্রনাথকে সমর্থন করেন এবং এই আন্দোলনকে কেন্দ্র করে তিনি যে গানটি লিখেছেন,
মায়ের দেওয়া মোটা কাপড় মাথায় তুলে নে রে ভাই;
দীন দুখিনি মা যে তোদের তার বেশি আর সাধ্য নাই।
গানের পাশাপাশি কবিতা লেখাতেও তিনি অসামান্য অবদান রেখেছেন। দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের কবিতা তাকে কবিতা লিখতে আগ্রহী করে তুলেছিল। জীবনের শেষ দিকে এসে তিনি নীতিকবিতা লিখেছেন অনেক। যেমন—
নদী কভু নাহি করে নিজ জলপান
তরুগণ নাহি খায় নিজ নিজ ফল,
গাভী কভু নাহি করে নিজ দুগ্ধ পান,
কাষ্ঠ, দগ্ধ হয়ে, করে পরে অন্নদান।
রজনীকান্ত সেনের লেখায় গানে উঠে আসে ঈশ্বরের প্রতি ভক্তি প্রেম বিশ্বাস আধ্যাত্ম চেতনার কথা। জীবনের সকল আনন্দে ও সংকটে তিনি ঈশ্বরের কাছে নিজেকে সমর্পণ করেছেন। তাঁর রচিত ভক্তিমূলক নানা গান প্রার্থনারূপে উপাসনালয়গুলোতে আজও গীত হয়।
তুমি নির্মল কর মঙ্গল করে, মলিন মর্ম মুছায়ে;
তব পূণ্য-কিরণ দিয়ে যাক, মোর মোহ কালিমা ঘুচায়ে।
কিন্তু তাঁর নাম যশের কিছুদিনের মধ্যেই তাঁর কণ্ঠনালীতে ধরা পড়ে ল্যারিঙ্কস্ ক্যানসার (Larynx Cancer)। জীবনের শেষ দিনগুলি তিনি খুব কষ্ট পেয়ে অতিবাহিত করেছেন। তাঁকে দেখতে হাসপাতালে যান রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। রজনীকান্তের জীবদ্দশায় তাঁর তিনটি বই প্রকাশিত হয়- ‘বাণি’, ‘কল্যাণী’, ‘অমৃত’। তাঁর মৃত্যুর পর প্রকাশিত হয় পাঁচটি গ্রন্থ- ‘অভয়া’, ‘আনন্দময়ী’, ‘বিশ্রাম’, ‘সদ্ভাবকুসুম’ ও ‘শেষদান’।
১৩ সেপ্টেম্বর, ১৯১০ সালে মাত্র ৪৫ বছর বয়সে কলকাতা মেডিকেল কলেজের কটেজ ওয়ার্ডেই কবি রজনীকান্ত সেন পরলোক গমন করেন। অনেকেরই হয়তো অজানা কবির নাতনি রমা সেন ‘সুচিত্রা সেন’ নাম নিয়ে ভারতীয় চলচ্চিত্রে এক শক্তিমতী অভিনেত্রী হিসেবে আবির্ভূত হন।এই মহান কবির অবদান বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে ও বাঙালি পাঠকের মনে চির উজ্জ্বল হয়ে থাকবে।
লিখলেন কাকলি কর্মকার