ধারাবাহিক: জলতরঙ্গ (পর্ব ১৬) — দীপান্বিতা বিশ্বাস
সবে সবে কদম আলির কাঁচা ঘরে বাঁশের বেড়া হয়েছে। তার উপর দিয়ে লজ্জাবতির শাখা উঠিয়ে দিয়েছে সে নিজেই। ঘরের ডান পাশে উঁচু করে রাখা মাটির এক পাত্র। সেখানে সকাল বিকেল জল ঢালে কদমআলি, পাখিরা খেতে আসে। নানান রকম পাখি। সে পাখির নাম অবশ্য আমার বিশেষ মনে নেই।
এসব কথা আমার জানা কথা নয়। দাদুর চিঠির সঙ্গে কদম আলিরও একখানা চিঠি আমি পেয়েছিলাম। একেবারে কাঁচা হাতের লেখা, অজস্র বানান ভুল। তবু সে চিঠি আমার কাছে ছিল এক আলোকবর্ষ সমান।
সেদিন কলেজ ছুটিই ছিল। আমি আরাম করে বসে একখানি কাগজে লেখার চেষ্টা করছিলাম মাত্র। লিখেছিলাম কিনা সেটাও মনে করতে পারিনা। কদম আলির চিঠির প্রতিটা শব্দের কাছে আমার যেকোনো লেখা একেবারেই তুচ্ছ। এমনই এক বসন্তের দিন, চারিদিক কেবল ধুলো উড়ছে। কলকাতা শহরে বসন্ত মানে রোদের তেজ খানিক বেশি কিংবা গঙ্গার তীব্র হাওয়া। এর বেশি কিছুনা। চিঠিটা হাতে পেয়ে কিছুক্ষণ চেয়ে রইলাম তার দিকে। কেউ অন্তত আমার জন্য চিঠি লিখেছে। কেউ অন্তত আলাদা করে ভাবে আমার জন্য। বড় মায়া হলো আমার কদম আলির জন্য। হাতে চিঠিটা নিয়ে জানলার ধারে গিয়ে বসলাম। দূরে এক শিমুল গাছে লাল লাল ফুল এসেছে। দেখলে যেন চোখ জুড়িয়ে যায়। আবার কদিন বাদেই তা থেকে তুলো ঝরে পড়বে তারপর বিকেল হলেই কাকেদের রাজত্ব। এবার শান্ত মনে চিঠিটা খুললাম।
স্নেহের ছোটমা,
কেমন আছো মা? আমি ভাল নাই। ওই দেখেছো আগেই আমার দুঃখের কথা শুরু করসি। শোনো তোমারে বুক ভরা ভালোবাসা দিলাম। শুধু যদি কাছের থেইকা তোমারে দেখতি পারতাম। আজই দুই বছর তুমি গেরামে আসোনা। তোমার বাবা আইলে কয় তোমার পড়াশোনার চাপ। আর মানসে কি পড়েনা কও মা? আমার তো এক তুমি ছিলা যারে মনের সব কিছু কইয়া শান্তি পাইতাম। সেই ছোটকালে মারে হারাইলাম আর এহন তুমি। ছিঃ ছিঃ থাপ্পড় মারন লাগে আমার গালে। একি কথা কইলাম। তোমারে ক্যান হারাইবো। তুমি তো আছো ছোটমা। শুধু লুকায় থাকো দেখা দাওনা।
জানো ছোটমা আমাগে দুর্ব্বা গাছের আলে ছোট ছোট অনেক ঘাস হইসে। একেবারে কচি কচি! ওই মাঠ পাড়ার ছাগল গুলান আইসা খাইয়া যায়। কত্তায়ও আজকাল কিস্যু কয়না। আগে হইলে একেবারে ঝড় তুইলা দিতো।
তয় নদীর জল কিন্তু এহোনো শুকায় নাই। আমি মাঝেমধ্যি যায়ে মাটি নিয়া আসি। আম্মায় আমারে কৈছিল না উহানে দ্যাশের গন্ধ লুকায় আছে। তুমি থাকলি দুদন্ড কথা অন্তত কইতে পারতাম। সেইডা আর হয়না। শ্যাষে চোখের পানি শুকায় আসলি ঘরে ফিরি। বেলা পড়ে যায়। কত্তারে দেহি বড় দালানে চুপচাপ বইসা থায়ে। আমার বড় দুঃখ জাগে মনে। কি কইতে কি কবো তাই আর কিস্যু কইতে পারিনা কত্তারে। গিন্নিমা সেই প্রথমের মতই চিল্লায় যায় সকাল বিকাল। আমার বড় ভালোলাগে এই চিল্লানো শুনতি। আমার ঠাকমা ঠিক এইরকমডা ছেল।
ও তোমারে তো বলা হয়নাই আমার কাঁচা ঘরে নতুন বেড়া দিসি। বাঁশ ফাইড়া তারে চিরে চারিপাশে সুন্দর করে সাজাইছি। একখান লজ্জাবতী গাছ আছে। অর গায়ে হাত দিলি একবারে গুটাই যায়। ওইযে কেয়ার মত। ও ছোটমা কেয়া কেউ না, ভুলি ভুলি বললাম। ওসব কিছুনা। ঘরের পাশে মাটির একখান উঁচু পাত্রে জল দিই পাখি জল খাইতে আসে। পাখিরে জল খাওয়ানো ভাল কত্তায় কইসে। দোয়েল, কোয়েল, ইষ্টিকুটুম, ছোটছোট টুনটুনি, ঢাক পাখি কত রকম পাখি আসে জল খাইতে। আমার ভারি আনন্দ লাগে মনে। তুমি থাকলি কি ভালই না হইতো ছোটমা। অনেক লিখে ফেলসি আজকে শ্যাষ করি। নাইলে কাজগখানি ভিইজা যাবে শ্যাষে!
সুখী হইও মা। আমার ছোটমারে আকাশের সমান ভালোবাসা পাঠাইলাম।
তোমার কদম চাচা
চিঠিটা পড়ে কি করা উচিত ভেবে পেলাম না। ফিরোজার বিয়ের সময় যেমন কষ্ট হয়েছিল আজকেও ততটাই কষ্ট হলো। চিঠিতে সত্যি খানিকটা মাটির গন্ধ আছে। রং নেই, ধুলো নেই আছে এক সকালের রোদ। যেইখানেতে আমার বাড়ি। যেই খানেতে কদম চাচার কান্নার জল পাথর জমায়। সেইখানেতে কষ্ট ভারি। আমরা মানুষ’রা আসলে বাঁচিই কষ্টকে সঙ্গে করে। সুখ তো কেবল প্রসাধন মাত্র।
লিখলেন দীপান্বিতা বিশ্বাস।