ধারাবাহিক: জলতরঙ্গ (পর্ব ১৪) — দীপান্বিতা বিশ্বাস
শীত চলে যেতেই রাস্তার দুধারে সমস্ত পাতাদের সভা বসে। আমি সেসব ফেলে একে একে এগিয়ে যাই শিলাবতী নদীর ধারে। শালবনের এক কোন থেকে উঁকি মারে গোটা কয়েক মহুয়া ফুল। তার বাসন্তী রং থেকে ঝরে পড়ে এক কবির না লেখা কবিতা।
কদমআলি বলতো কবিরা হচ্ছে গাছের মত। আমি বলতাম-
— চাচা কবিরা গাছের মত কেন?
— এ তো সহজ হিসেব ছোটমা।
— কবিরা তো ছন্নছাড়া চাচা।
— কি কও তো ছোটমা আমরা জীবনডারে অনুভব করি আর কবিরা জীবন দেয়। গাছ যেমন আলো ছাইড়া, জল ছাইড়া বাঁচবো না তেমন কবিরা কবিতা ছাইড়া শব্দ ছাইড়া বাঁচবো না। কবির কালি হচ্ছে গিয়ে এক একটা বিপ্লব। আমাগো দ্যাশে নুজরুল ছ্যালো না! অর কত কবিতা শুনে আমরা বড় হইছি। অর কত শব্দ নিয়া মিটিঙ মিছিল হইসে।
— তুমি নজরুলের কবিতা জানো চাচা?
— সেকি কতা ছোটমা? ওমন একজনের ভাষা, শব্দ শোনবো না তা কি হয় কও!
“এইখানে এসে লুটাইয়া পড়ে সকল রাজমুকুট।”
এইসব কথা শুনে মাঝেমাঝে আমার ভারী অবাক লাগতো। এই মানুষটার মধ্যে এত বিদ্রোহ লুকিয়ে আছে সে কিনা দেশ থেকে পালিয়ে এলো! এই মানুষটার কাছে তার ভিটের কথা শুনে শুনে আমি যেন ভাদ্র মাসের পড়ন্ত রোদ হয়ে যাই। ভোরের হালকা কুয়াশায় হাঁটতে হাঁটতে কাঁদামাটি মাখা সেই নদীর ধারে গিয়ে চিৎকার করি “ওগো শরৎ আমাকে দুমুঠো মেঘ দেবে? এ মেঘ ও পাড়ে নিয়ে গিয়ে কদম আলির দুঃখ ধুইয়ে দেব এক পশলা বৃষ্টিতে। শরৎ সাড়া দেয়না। মুখ লুকিয়ে থাকে গভীর অরণ্যে। আমার কেবল জানি মনে হয় কদম আলি যাবার পথে, দুঃখ ছড়িয়ে একমন বিপ্লব নিয়ে নদীতে ঝাঁপ দেবে।
যে নদীতে বান আসেনা কোনোদিন। যে নদীতে নৌকা চলে গভীর রাতে। রক্ত ধোয়া লালচে জলে হারিয়ে যাবার গল্প ভাসে। সে নদীতে মনকেমনের গান উড়ে যায়। পাতায় করে দুঃখ আসে, খানিক হাসে। আবার যেন কই চলে যায়।
তখন আমি অনেক ছোট। লাল ফ্রক পরতাম, তাতে হলুদ নীল সুতোর ফুলফুল নকশা করা। দাদুর সঙ্গে মেলায় যেতাম পুতুল নাচ দেখতে। সামনে ছোট স্টেজ, স্টেজের উপরে একটু ফাঁকা। স্টেজের সামনে তাঁবু পেতে দর্শকদের বসতে দিতো। আমি বসে একমনে পুতুল নাচ দেখতাম। পুতুলগুলোকে একেবারে মানুষের মতন দেখতে। তারা কথা বলতো হাসতো ঘুমাতো। শুধু মাথার উপর দিয়ে সুতো ঝুলতো। যেন মানুষ নামক ঈশ্বর মাথার উপর দিয়ে সুতো ঝুলিয়ে প্রতিটা চরিত্রকে নিজের মত করে চালনা করছে। আমরা মানুষরাও খানিকটা সেরকম। আলো অন্ধকারের মধ্যে যে কোনো একটাকে ঈশ্বর ভেবে নিয়ে সেদিকে এগোতে থাকি। কেউ কেউ আবার আলো বা অন্ধকার কোনোটাই দেখতে পায়না। তাদের কাছে ঈশ্বর মানে নিজের প্রতিবিম্ব। আয়না জুড়ে অহংকার খেলা করে সর্বত্র। আবার কেউ কেউ কদম আলির মত অসহায়। তাদের কাছে ঈশ্বর অর্থ সহানুভূতি। সেটুকু হলো মানেই স্মৃতি গুলো ভাঙতে শুরু করে গল্পের মত। সেসময় পশ্চিম আকাশে আলো দ্রুত নিভে যায়। পড়ে রয় গোটা কয়েক ফিরতি পথের পাখির ডাক।
ধারাবাহিক: জলতরঙ্গ লিখলেন দীপান্বিতা বিশ্বাস।