রিভিউ: ভক্তের চোখে রূপম ইসলাম একক— প্রিয়ম সেনগুপ্ত
রিভিউ সিরিজ ‘ভক্তের চোখে’: ১৬ আগস্ট অনুষ্ঠিত হল রূপম ইসলাম একক। সেই অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করেই ‘ভক্তের চোখে রূপম ইসলাম একক’ লিখলেন প্রিয়ম সেনগুপ্ত ।
শুরুতেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। কলামের নাম যখন ‘ভক্তের চোখে রূপম ইসলাম একক’, তখন শো–রিভিউয়ের সময়ে ভক্তের পোশাকটাও শরীরে চড়িয়ে নিতে পারব। সাধারণত সাংবাদিকের কিছু দায় থাকে। পোশাকি ভাষায় যাকে বলে ‘এডিটোরিয়াল পলিসি’। সেখানে কোনটা লেখা যাবে, কাকে নিয়ে লেখা যাবে— এমন নানা ‘ডুজ অ্যান্ড ডোন্টস’ থাকে। বিবিধ ডট ইন–কে ধন্যবাদ, তারা এমন কোনও শৃঙ্খলার শৃঙ্খল এই প্রতিবেদকের হাতে পরিয়ে দেয়নি।
বাঁচা গেল, আমারও এই প্রতিবেদন লেখার ক্ষেত্রে কোনও কেতাবি নিয়ম না মানলে চলবে। অতএব পেশাদার সাংবাদিকের পোশাকের সঙ্গে ঘোষিত ভক্তের উত্তরীয়টিও গলায় জড়িয়ে নিলাম আমি।
তাই শুরুতেই লিখে ফেলা যায়, রূপম ইসলাম শুধু গান গাইতে আসেননি। এসেছেন গোটা একটি প্রজন্মের চুলের মুঠি ধরে ঝাঁকিয়ে দিতে। যে ঝাঁকুনি সুখস্বপ্নের আদুরে আলসে ঘুমের সাড়ে সর্বনাশ করে তাকে দাঁড় করিয়ে দেয় কর্কশ কঠোর বাস্তবের মুখোমুখি। যেমনটা ঋত্বিক ঘটক দিতেন, যেমনটা নবারুণ ভট্টাচার্য দিতেন অথবা দিতেন হাংরি প্রজন্মের কবিরা। ( ‘ভক্তের চোখে রূপম ইসলাম একক’ লিখলেন প্রিয়ম সেনগুপ্ত )
সেদিক থেকে দেখতে গেলে রূপম ঋত্বিক–নবারুণদের উত্তরসূরি। তিনি এক প্রবল হাংরি যুবক এই ছেচল্লিশে এসেও। না হলে জন লেননের মতো কিংবদন্তির পাঁজরের ওপরে দাঁড়িয়ে অনুষ্ঠান শুরু করার ঘোষণা করতে পারেন কেউ? অনায়াসে গড়গড় করে বলে যেতে পারেন লেননের হত্যার অকুস্থলে দাঁড়িয়ে তাঁর দিকে ছুটে আসা বিদ্রুপের কথা? শুধু লেনন? একের পরে এক মানুষের মৃত্যুশোক বারবার শরীরে মেখে সুর ছুড়ে দিচ্ছিলেন তিনি। আইয়ুব বাচ্চু, সুশান্ত সিং রাজপুত, ঋজু বসাক... এঁদের প্রয়াণের (অথবা চলে যাওয়ার) গনগনে শোকের আগুনে রূপম ফেলে কষছিলেন মৃত্যু, বিচ্ছেদ, নস্ট্যালজিয়া, অপমানের ঋণের মশলা। অদৃশ্য আগুনটা জ্বলছে কোথাও। তার গনগনে তাপে ক্রমশ লাল হয়ে উঠছিল রূপমের চোখ–মুখ। ক্রন মনে পড়ে যাচ্ছিল, এই রূপমই বলেছিলেন, সুখী মানুষের জন্য রক মিউজিক নয়। রক মিউজিক করতে গেলে অনেক কান্না–রক্ত–ঘাম ঝরাতে হয়। বলেছিলেন, ‘আমার প্রথম জীবনটা যদি সুখে কাটতো, তাহলে হয়তো দেওয়ালি পি–র মতো গান আমার লেখা হতো না।’
কতখানি ক্ষোভ নিজের মধ্যে পুষে রেখেছেন রূপম? কতখানি আগুন? কতটা লাভা? মাঝেমাঝে মনে হচ্ছিল, ওঁর ঢাকুরিয়ার ফ্ল্যাটের ওই ছোট্ট ঘরটা এই আগুনের তাপ নিতে পারবে তো? সেই তাপ সওয়ানোর জন্য যেখানে গোটা গোটা নজরুল মঞ্চের পরিসরও বারেবারে কম পড়েছে, যাঁর আঁচের সামনে বারবার ম্লান হয়ে গিয়েছে রাশি রাশি ক্যামেরার ফ্ল্যাশের ঝলকানি, সেই তিনি নিশ্চয়ই গৃহবন্দী অবস্থায় ঘরের মধ্যে দুটোমাত্র ক্যামেরার সামনে করুণাবশত নিজের উত্তাপ কমিয়েই দেবেন।
ভুল। রূপম মেপে ঢালতে শেখেনইনি। গৃহবন্দী রূপম আনপ্লাগড ফরম্যাটেও যে আগুন উগরে দিলেন সেটা দেখে বাংলাদেশের রক কিংবদন্তি মাকসুদুল হক (ম্যাক)–ও কমেন্ট করে বসলেন, ‘আই অ্যাম হিয়ার’। দ্রোণাচার্য ম্যাক হকের ঘোষিত একলব্য রূপম। ক্যামেরার ওপার থেকে গুরুর আবির্ভাব টের পেলেন কি তিনি? নইলে কেনই বা সঙ্গে সঙ্গে মটমট করে ভাঙতে শুরু করবেন দেশ, সীমান্ত, জাতি, ধর্মের বেড়া। কেনই বা লেলনকে নিয়ে গান গাইতে গাইতে মিলিয়ে দেবেন লালনের সঙ্গে? পাশ্চাত্য তারকার হত্যা নিয়ে লেখা গান ‘লেননের মৃত্যু’। সেখানে বারংবার মিলে গেল ভারতীয় রাগ ইমন।
কে বলেছে রূপম শুধু লিরিকে আন্তর্জাতিক? লেননকে নিয়ে লেখা গানে রাগ ইমনের ব্যবহার! এটা আন্তর্জাতিক মানের কম্পোজিশন নয়? আর কার হিম্মত হবে রূপম ছাড়া। করে দেখানো তো পরের কথা।
অনুষ্ঠানের শুরুতেই বারংবার রূপম যখন টানছেন কালজয়ী কিংবদন্তি লেননের মৃত্যুর প্রসঙ্গ। তখনই ক্রমশ নেপথ্যের ছায়ায় জমাট বেঁধে আসছেন এমন আর এক কিংবদন্তি, যাঁর জন্মদিন সেই ১৬ আগস্টই। আইয়ুব বাচ্চু। আবেগমথিত রূপম জানালেন, বাচ্চুভাইয়ের সঙ্গে তাঁর শেষ সাক্ষাতের কথা। যেখানে তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন,
এটাই শেষ নয়। তিনি আবার আসবেন।
বাচ্চুভাই এলেন। তবে অশরীরী হয়েই। বসলেন রূপমের কণ্ঠে, বসলেন শ্রোতাদের প্রত্যেকের পাশে। রূপম আক্ষেপের সুরে বলেছিলেন, বাচ্চুভাই তাঁর বাড়িতে এসে বলেছিলেন, এটাই শেষ আসা নয়। কিন্তু এই যে রূপের কণ্ঠে আইয়ুব বাচ্চু ধ্বনিত হলেন, সেই আসাটাও কি আইয়ুব বাচ্চুচিত ধমাকাদার প্রত্যাবর্তন নয়?
শুরুতেই বলেছিলাম, যে কোনও সংবাদপ্রতিষ্ঠানেরই কিছু ‘ ডু’জ অ্যান্ড ডোন্টস ’ থাকে। বাংলা ব্যান্ডের শিল্পীদের অবহেলা করাটা বোধহয় সেই ‘ডুজ’–গুলির একটা অংশ। অবাক লাগে এটা দেখেই, বাংলাব্যান্ডের পাশাপাশি যেভাবে মৌলিক গানের ক্ষেত্রেও রূপম নিজের একটা বৃহত্তর ছায়া তৈরি করে ফেলেছেন, সেটাও কি তাদের চোখ এড়িয়ে যাচ্ছে? কোনও সচেতন সাংবাদিকেরই সেটা যাওয়ার কথা নয়। কোনও শিল্পীর প্রত্যেকটি একক অনুষ্ঠান বলে বলে হাউজফুল হচ্ছে, কোনও শিল্পীর গাদাগুচ্ছের অপ্রকাশিত গান শ্রোতারা কণ্ঠস্থ করে ফেলছেন, গলা মিলিয়ে গাইছেন, এই ডিজিটাল অ্যালবামের যুগেও বইমেলায় হাঁটাচলা করার রাস্তা বন্ধ করে দিচ্ছে কোনও শিল্পীর সদ্য প্রকাশিত অ্যালবাম কেনার জন্য জমাট বাঁধা ভিড়— এসব কি তাঁরা জানেন না?
দিব্যি জানেন। বলতে বাধ্য হচ্ছি, জেনেও না জানার ভান করেন তাঁরা। রূপমের কট্টর সমালোচকদেরও দেখেছি ‘আমি’ শোনার পরে গোপনে মুগ্ধতার কথা জানিয়ে এই প্রতিবেদকের সঙ্গে টেক্সট বিনিময় করতে। অথচ তাঁরা প্রকাশ্যে কোনওদিন স্বীকার করবেন না এসব কথা। কোনওদিন সেই সাংবাদিকরা লিখবেন না, গৃহবন্দী অবস্থায় ঐতিহাসিক যে একক হল, তারপরে গোটা বাংলার সোশ্যাল মিডিয়ার দখল নিয়েছিলেন এককে মন্ত্রমুগ্ধ হওয়া শ্রোতারা। এককের পরে প্রতিবার যে ‘আফটার পার্টি হয়’ সেখানেই রূপমকে যখন জানানো গেল, শ্রোতাদের প্রতিক্রিয়া অভূতপূর্ব, তখনও সামান্য মুচকি হাসি ছাড়া আর কিছুই পাওয়া যায়নি শিল্পীর কাছ থেকে। অর্থাৎ ‘এটাই তো আমি।’
কার্যত শ্রোতাদের আবেগ নিয়ে কাঠের পুতুলের মতো নাচালেন রূপম। তিনি হাসলে শ্রোতারা হাসলেন, তাঁর চোখে জল এলে কমেন্ট বক্স ভরে গেল আবেগী মন্তব্যে। আবার যখন উন্মত্তের মতো উচ্চগ্রামে আক্রোশ উগরে দিলেন রূপম, মেরুদণ্ড বরাবার ঠান্ডা স্রোত বইল দর্শকদের। আফটার পার্টির ফাঁকেই প্রশ্ন উঠল, অতটা উত্তেজিত হওয়ার প্রসঙ্গ নিয়ে। কান পেতে শোনা গেল সেই কথোপকথনের খণ্ডাংশ। শীতল কাটাকাটা উচ্চারণে রূপমের জবাব, ‘যে ওরকম উত্তেজিত হয়ে পড়েছিল, সে আমি নয়। অন্য কেউ। আমি তখন একটা উত্তেজিত লোকের ভূমিকায় ঢুকে পড়েছিলাম।’
এই প্রতিবেদক এই জবাব মানতে রাজি নন। কারণ, ওই দুটো মানুষই রূপম। বাস্তবেও গোটা জীবন ধরেই একটা একক করে চলেছেন রূপম। সেখানে তিনি কখনও অপমানিত হচ্ছেন, আবার সপাটে জবাব দিচ্ছেন, দাঁতে দাঁত চেপে লড়ছেন। আবার ক্ষেত্রবিশেষে বুক ঠুকে বলছেন, ‘আমিই পারি।’ অনুষ্ঠানের মাঝেই তাই চোখে জল জমাটা তাই কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। ফসিল্সের মঞ্চ হোক বা একক, সেই পরম্পরা ক্রমেই চলছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় এককের রিভিউ ঝড়ের মধ্যেই রূপম বলে দিয়েছেন, ‘আমি জীবনে যতগুলো অনুষ্ঠান সিরিয়াসলি নিয়েছি, প্রত্যেকটি অনুষ্ঠান আমায় কাঁদিয়েছে। কারণ, আমি বিশ্বাস করি কান্না আক্রোশ চিৎকার হাসি আনন্দ সঠিক সুরক্ষেপণ আরও যা যা— সবটুকু মিলেই রক মিউজিক। আমি কি শুধুই কাঁদলাম নাকি রে? আমি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হইনি? আমি পাল্টা আক্রমণ করিনি? আমি মিথ্যেবাদীদের মুখোশ খুলে দিইনি? সবটা মিলিয়েই জীবন। কোনওটা বাদ দিলে ওটা জীবন নয়। রক মিউজিক নয়। তুমি দেখতে পেলেই কান্না? তুমি না দেখতে পেলেই কান্না না? ফসিল্স-এর মঞ্চে আমি তো নিয়মিত কাঁদি। আমার গানের পংক্তিগুলো পড়ে কী মনে হয়? ছত্রে ছত্রে কান্না নেই? বিদ্রোহ নেই? ক্রোধ নেই? আমার তৈরি করা গান নিয়ে সাড়ে তিন ঘণ্টার অনুষ্ঠান করবে একজন পারফর্মার— একবারও তার চোখে জল আসবে না— সে পারফর্মার নয়। একটি পাথর। নিরেট পাথর।’
নিজের গান সম্পর্কে এই আত্মবিশ্বাসী মন্তব্য কোনও সুখী কবি করতে পারেন না। তিনিই পারেন, যিনি নিজের গানের প্রত্যেকটি পংক্তিকে পেট্রোলের মতো পুড়িয়ে জীবনে চলার জ্বালানি বানাতে পেরেছেন। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ঘরের নরম সোফায় বসে এ জিনিস লেখা যায় না। আর ঠিক সেই কারণেই রূপম ইসলাম একক স্রেফ একটা গানের অনুষ্ঠান নয়। দর্শনের শ্রেণিকক্ষ। জীবনের কঠোর–কর্কশ অভিজ্ঞতাকে উত্তরাধিকার হিসেবে পরের প্রজন্মের হাতে তুলে দেওয়ার এক আগে কখনও না দেখা প্রোজেক্ট।
রূপম গাইছিলে ‘আজও না বলা গল্পরা’, রূপম গাইলেন ‘হাওয়ায় পা’। আপনার গানে এত মৃত্যু কেন রূপম? এত বিষাদ কেন? আপনি বলছিলেন আপনার গান নাকি সবচেয়ে বেশি শোনেন ১৭ থেকে ৩৫ বছরের যুবক–যুবতীরা। তাঁরা তো বলেন, আপনার গান তাঁদের কাছে বেঁচে থাকার রসদ। সেই রসদে আপনি সযত্নে ঢালছেন মৃত্যুচেতনা?
কেন? এ প্রশ্ন পরে কোনও সাক্ষাৎকারে আপনাকে করা যাবে। এখন বরং আলোচনা করা যাক উত্তরাধিকার হস্তান্তরের প্রসঙ্গে। আপনার পিতা ও মাতার তৈরি করা গান একটি একটি করে করার যে পরম্পরা আপনি এককে শুরু করেছেন, তা এক অনবদ্য প্রয়াস। এ প্রয়াস চলতে থাকুক।
রূপম জানিয়েছেন, এই এককই ডিজিটাল কনসার্টের এই দফার শেষ একক। বিগত ৪৫ দিনে ৩টে একক করার পরে যে কোনও শিল্পীরই একটু ছুটি প্রাপ্য। তবে সোশ্যাল মিডিয়ায় চোখ মেললে দেখতে পাবেন, একক হয়ে যাওয়ার ২৪ ঘণ্টা পরেও কী উন্মাদনা চলছে আপনাকে নিয়ে, এই একক নিয়ে। আপনি রূপম ইসলাম। প্রায়ান্ধকার ঘরে হাপরের আগুনের আঁচে টকটকে লাল ইস্পাতে হাতুড়ি ঠুকে যাওয়া কর্মকারের মতো পরিশ্রমী ক্লান্তিহীন চরিত্র। ছুটি আপনাকে মানায় না। আপনার শ্রোতা ছটফটিয়ে জানতে চাইছেন পরের একক কবে?
শুনতে পাচ্ছেন রূপম?
রিভিউ সিরিজ: ১৬ আগস্টের অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করেই ‘ভক্তের চোখে রূপম ইসলাম একক’ লিখলেন প্রিয়ম সেনগুপ্ত ।
ছবি: রূপম ইসলাম ফেসবুক পেজ
এক কথায় জীবন আর মরনের মাঝে যুদ্দ্ব করা